November 12, 2024, 7:59 pm
অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম/
আজকাল গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপাচার্যগণের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি নিয়ে প্রায়শ খবর প্রকাশিত হতে দেখছি। আমিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে আমার নামটিও রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অগত্যা ‘একজন উপাচার্যের কৈফিয়ত’ এই নাম দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার দায়িত্ব পালনের প্রথমদিকে প্রায় এক-দেড় বছর ছিল করোনাকাল। সেই সময় আমি ও আমার স্ত্রী দুজনই দুবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। করোনাকালে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়েও কম-বেশি সব কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও উপাচার্যের অফিস চলত প্রায় স্বাভাবিক সময়ের মতো। এ সময়ে আমাদের প্রধান চেষ্টা ছিল অনলাইন এবং পরবর্তীতে অনলাইন-অফলাইন সমন্বিত মোডে কী করে ক্লাস-পরীক্ষা চালু রাখা যায়। আমার একটি তৃপ্তির অনুভূতি যে, তখন থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে; নানারকম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ক্লাস-পরীক্ষা এক দিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি কিংবা তেমন কোনো অস্থিরতাও তৈরি হয়নি।
গত এক-দেড় বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে। এখানে বিশেষ করে কিছুসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যারা কম-বেশি সব আমলে উপাচার্যের প্রীতিভাজন হয়ে প্রশাসনকে কবজায় নিয়ে নিজেদের মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চান। এমনটি না হলে সাধারণত কোনো উপাচার্যই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হন না। জন্মকাল থেকে ১৩ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত এক-দুজন উপাচার্য কেবল মেয়াদ শেষ করতে পেরেছেন। যা হোক এ শিক্ষকগণের কেউ কেউ সুবিধা করতে না পেরে অন্তত এক-দুজন শিক্ষক আমাকে এমনও বলেছেন, পূর্বে কম-বেশি সব উপাচার্য তাদের নিয়ে চলেছেন, অথচ আমার সময়ে তিনি/তারা একটু ঝাড়ুদারের দায়িত্বও পাচ্ছেন না। এরপর থেকে দিনে দিনে শুরু হয়েছে অনলাইন ও বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের প্লাবন। একটি একটি করে তা পাঠকের জন্য তুলে ধরতে চাই।
প্রায় দেড় বছর আগে হঠাৎ করে এক দিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ভ্যানে মাইক লাগিয়ে আমার কণ্ঠসদৃশ বাক্যাংশের একটি অডিও বাজিয়ে কে বা কারা প্রচার করতে থাকে যে, উপাচার্য হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগবাণিজ্য করছি। মূলত ঘটনাটি ছিল এমন, ওই সময়ে শিক্ষকশূন্য একটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে মাত্র তিনটি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল এবং নিয়োগ পরীক্ষায় দুজন প্রার্থী উপস্থিত হয়েছিলেন। আমরা প্রার্থী স্বল্পতার জন্য ওই পরীক্ষা বাতিল করে পুনঃবিজ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নিই। এর কয়েকদিন পর আমি আমার এক ছাত্রকে (যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও বটে) অনুরোধ করি যে, তোমরা ঢাকায় থাক, আমাদের শিক্ষক দরকার। তুমি আমাদের একটু সাহায্য কর-তোমার বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনদের বল তারা যেন এখানে দরখাস্ত করে। উত্তরে সে জানায়, স্যার ওখানে কেউ যেতে চায় না। তা ছাড়া একটা দরখাস্ত করতে গেলে ৫-৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়-তাই কেউ দরখাস্ত করতেও উৎসাহী হয় না। আমি তখন জবাবে বলি- ওরা তোমাদেরই বন্ধুবান্ধব, প্রয়োজনে টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করে তাদের দরখাস্ত করতে একটু উদ্বুদ্ধ কর। এই কথোপকথনের ‘টাকা-পয়সা দিয়ে’ বাক্যাংশটুকু নিয়ে কীভাবে তারা একটি অডিও বানিয়ে প্রচার আরম্ভ করে, উপাচার্য নিয়োগবাণিজ্য করছেন। শুনেছি এভাবে তারা একাধিক অডিও [যা শুধু একজন অর্থাৎ আমার কণ্ঠসদৃশ এবং তা মিথ্যা, বানোয়াট, খণ্ডিত, একপক্ষীয় (অন্য প্রান্তে কে কী বলছেন তার কোনো হদিস নেই) এবং হয়তোবা সুপার এডিটেড] বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে উপাচার্যকে কীভাবে হেনস্তা করে তাদের অপইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করানো যায় সে চেষ্টাই তারা অনবরত করে যাচ্ছে। আমি আমার কণ্ঠসদৃশ আরও একটি অডিওর বক্তব্য শুনেছি। এটিও ছিল একপক্ষীয় এবং খণ্ডিত। আমার আলাপন সেখানে পূর্ণাঙ্গ নেই। অপর প্রান্তে কে কথা বলছেন তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। অডিওর বিষয়টি হলো-আমি কোনো একজনকে বলছি, ‘আপনার নির্দিষ্ট প্রার্থীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন… আমি দেখব। সাধারণত কোনো নিয়োগের আগে অনেকে অনুরোধ করেন যাতে তার প্রার্থীকে যেন একটা চাকরি দেওয়া হয়। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিগণ অথবা কোনো রাজনীতিক/সামাজিক ব্যক্তিত্ব একটি পদের জন্য কখনো কখনো ৩-৪ জন প্রার্থীর রোল নম্বর পাঠিয়েও এ ধরনের অনুরোধ করেন। ধরা যাক, এদের মধ্যে একজনেরই চাকরিটি হয়েছে। অধিকাংশ সময়ে সে ফিরে গিয়ে তার জন্য অনুরোধকারীকে সুখবরটি জানায় কি-না তা আমার জানা নেই। কিন্তু প্রায়শ এমনটি ঘটে যে, বাকি যাদের চাকরি হয় না তারা গিয়ে তাদের স্ব-স্ব নেতা বা অনুরোধকারীকে এই বলে বিষিয়ে তোলে যে, উপাচার্য আপনার অনুরোধের কোনো দামই দিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে মন খারাপ করে জনপ্রতিনিধিগণ বা রাজনৈতিক/সামাজিক নেতৃবৃন্দ টেলিফোন করে আমাকে হয়তো বলে থাকেন-আপনি আমার একটা অনুরোধ রাখলেন না। এমন পরিস্থিতিতে আমাকে জবাব দিতে হয় যে, এরপর তাহলে আপনার সুনির্দিষ্ট প্রার্থীকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন, আমি দেখব। এই ‘দেখা করতে বলা’ কি নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে যায়? এভাবে একটি গোষ্ঠী কেবলই মিথ্যাচার করে উপাচার্য হিসেবে আমাকে নাজেহাল করার অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে আমি নতি স্বীকার করে তাদের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করি। মিথ্যার কাছে নতি স্বীকার করে বেঁচে থাকার ইচ্ছা বা অভিপ্রায় আমার নেই।
আমার বিরুদ্ধে নাকি অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজে আমি অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার বিল বানিয়ে অর্থ-আত্মসাৎ করেছি বা করার চেষ্টা করেছি। রুচিহীন এবং উদ্ভট এসব অভিযোগের জবাব দিতেও আমি ইতস্ত বোধ করছি। উল্লেখ্য, নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি পরিমাপ করে ৩-৪ মাস অন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিল ঠিকাদারকে প্রদান করা হয়। এ কাজে বিভিন্ন পর্যায়ে সাইট ইঞ্জিনিয়ার-সহকারী ইঞ্জিনিয়ার-নির্বাহী বা তত্ত্বাবধায়ক ইঞ্জিনিয়ার-প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক প্রমুখ কর্তৃক পরীক্ষিত ও নিরীক্ষিত কাজের পরিমাপ এবং প্রস্তাবিত বিল ঠিক থাকলে তা চলে যায় ট্রেজারার মহোদয়ের কাছে। তখন তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ভিজিলেন্স টিম সরেজমিনে সাইট পরিদর্শন করে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তা উপাচার্যের কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। বর্ণিত ক্ষেত্রে আমার কাছে ফেবরিকেটেড ওই বিল অনুমোদনের জন্য কোনো ফাইলই উপস্থাপিত হয়নি। বরং ৪-৫ মাস আগে আমার দফতরে একটি বেনামি চিঠি আসে যে, নির্মাণকাজ বেশি দেখিয়ে ৮ কোটি টাকার একটি বিল প্রস্তুত করে তা প্রক্রিয়া করা হয়েছে। এই চিঠির সঙ্গে ফটোকপিকৃত কিছু ডকুমেন্ট ছিল, যা দেখে অভিযোগের সত্যতা থাকতে পারে বলে আমার কাছে মনে হয়েছিল। আমি তাৎক্ষণিকভাবে এই চিঠির ভিত্তিতে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে আহ্বায়ক এবং খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। ইতোমধ্যে কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় তা উপস্থাপিত হবে এবং সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে উপাচার্য হিসেবে আমি কী দুর্নীতি করেছি আশা করি পাঠকবর্গ তা উপলব্ধি করতে পারছেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে দু-একটি অনলাইন পত্রিকায় নিউজ করানো হচ্ছে যে, প্রকল্প সাইটে মাটির নিচে পাইলিংয়ের জন্য যে রড ঢোকানো হয়েছে সেখানেও নাকি উপাচার্য হিসেবে আমি দুর্নীতি বা অনিয়ম করেছি। যে কোনো নির্মাণে পাইলিংয়ের জন্য মাটির নিচে রড কতটুকু ঢোকাতে হবে তা নির্ভর করে সয়েল টেস্ট রিপোর্টের ওপর। আমি উপাচার্য হিসেবে যোগদানের বহু আগে প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সয়েল টেস্ট করে প্রকল্প দলিল প্রণীত ও অনুমোদিত হয়েছিল।
আমার সময়ে এসে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর যখন পাইলিং আরম্ভ হয় তখন সংবাদ কর্মীদের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, প্রকল্প দলিল অনুযায়ী মাটির নিচে যে পর্যন্ত রড ঢোকানোর কথা (ধরা যাক ৫র্০) তার চেয়ে কম গভীরতায় রড ঢুকিয়ে পাইলিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলীকে বিষয়টি দেখতে বলি এবং ভিজিলেন্স টিম পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলি। ভিজিলেন্স টিমের সদস্য এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের কর্মকর্তাগণ আমাকে এসে রিপোর্ট করেন যে, সয়েল টেস্টিংয়ের ভিত্তিতে যেভাবে পাইলিংয়ের রড প্রকল্প অনুযায়ী মাটির নিচে ঢোকানোর কথা বাস্তবে তা ঢোকানো যাচ্ছে না। রড ঢুকছে তার কম (কম-বেশি ৪র্০)। এ পর্যায়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় সয়েল টেস্ট ও তা ভেটিং করিয়ে টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই গভীরতায় রড ঢুকিয়ে পাইলিংয়ের কাজ করা হয়েছে। এ বিষয়টি প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, আইএমইডি, ইউজিসির প্রতিনিধিগণ থাকেন) সভায় অবহিত করা হয়েছে। এখানে উপাচার্য কীভাবে রড কম গভীরতায় ঢুকিয়ে দুর্নীতি বা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন সে বিবেচনার ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমি প্রায়শ শুনি, আমার বিরুদ্ধে নাকি আরও একটি অভিযোগ যে, আমি অবৈধভাবে কর্মকর্তাদের উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান করেছি। বিষয়টি আমি নিচে ব্যাখ্যা করছি। তার আগে বলে রাখা দরকার যে, এটি ডেপুটি এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার পর্যায়ের সব কর্মকর্তার জন্য একটি আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিষয়। এটি প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ইউজিসি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বছরে একাধিকবার অডিট করেন তারা আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু উপাচার্যের দুর্নীতির উপাদান এখানে কী থাকতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। ঘটনাটি ছিল এমন, ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এক ধাপ উচ্চতর স্কেলে বেতন উন্নীত করে তা প্রদান করা হতো। ২০১৫ সালের বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর এই সুযোগ রহিত করা হয়। আমি ২০২০ সালের শেষদিকে করোনাকালে যখন এখানে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি তার কয়েকদিনের মধ্যে ওই পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি অংশ এসে আমার সঙ্গে দেখা করে দাবি জানায় যে, এই স্কেল উন্নীতকরণ ঘটবে উপ-রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার পর্যায়ের সব কর্মকর্তার ক্ষেত্রে। কিন্তু পূর্বের প্রশাসন ২০১৯ সালে বেছে বেছে তাদের অনুগত কর্মকর্তাদের এই সুযোগ প্রদান করেছে- কাজেই অবশিষ্টদেরও এটি দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের দিকে তারা একটি বড় আন্দোলন গড়ে তোলে এবং প্রায় দুই মাস ধরে কর্মবিরতি পালন করে। একপর্যায়ে গিয়ে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দেখতে পায় এই সুবিধাটি ২০১৫ সালের পে-স্কেলের সময় রহিত করা হলেও ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি তখনো চালু রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সুবিধা আগে অলরেডি কর্মকর্তাদের একটি অংশকে দেওয়া হয়েছে এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো এই সুবিধা প্রদান বহাল রয়েছে। এ বিবেচনায় কর্মকর্তাদের আরেকটি অংশ যাতে বঞ্চিত না হয় (অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার পরিস্থিতি) সেসব বিবেচনায় নিয়ে কমিটি বঞ্চিতদের জন্য স্কেল উন্নীতকরণের সুপারিশ করে। এই সুপারিশ ফিন্যান্স কমিটি এবং সিন্ডিকেটে এই শর্তে অনুমোদন দেওয়া হয় যে, এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে কখনো যদি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয় তাহলে এই উন্নীতকরণ বাতিল হবে এবং কর্মকর্তাদের দেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হবে। বিষয়টি সে সময় এভাবে ফয়সালা করা হয়েছে। এখানে উপাচার্য হিসেবে আমার দুর্নীতির জায়গাটি কোথায় তা আমার বোধগম্য নয়। আমি মনে করি, এটি বড়জোর একটি অডিট আপত্তি/অনাপত্তির বিষয়। ব্যক্তি বা সামষ্টিক দুর্নীতির সংজ্ঞার সঙ্গে এটি যায় কি?
উপাচার্য হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ সম্পর্কে দু-একটি অনলাইন পত্রিকা এবং নষ্টভ্রষ্ট ওই গোষ্ঠীর প্রচার-প্রপাগান্ডা থেকে জেনেছি, আমি আমার ঢাকার বাসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সিকিউরিটি নিয়োগ দিয়েছি। এটি সর্বৈব মিথ্যা রটনা। ঢাকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রেস্ট হাউস রয়েছে। সেখানে মাত্র দুজন কর্মী (একজন কুক, একজন সাধারণ) কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা (কখনো কখনো তাদের পরিবার-বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য) ঢাকায় গিয়ে রেস্ট হাউসে অবস্থান করেন। উল্লেখ্য, এ সময়ে বেশ কয়েক মাস ধরে রেস্ট হাউস ভবনের সংস্কার কাজ চলছিল। রেস্ট হাউসে ইবি পরিবারের সদস্যগণ দিনেরাতে (কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই) যাতায়াত করেন। তাদের জন্য বারবার গেট খোলা এবং লাগানোর মতো কোনো জনবলই সেখানে ছিল না। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী স্থায়ী জনবল নিয়োগেরও তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। সে সময় অ্যাস্টেট অফিস থেকে আমাকে জানানো হয় যে, ঢাকা রেস্ট হাউসে কিছু সিকিউরিটি ডেপুট (নিয়োগ নয়) করা দরকার। ইবি ক্যাম্পাসের কয়েকজন আনসার দিয়ে সেটা করা যায় কি-না সে ব্যাপারে অ্যাস্টেট অফিস আমাকে অবহিত করে যে, আনসার ডেপুট করা অনেক খরচের ব্যাপার এবং বারোজনের নিচে আনসার কর্তৃপক্ষ জনবল দেবে না। বিকল্প হিসেবে স্বল্পসংখ্যক (৫-৬ জন) জনবল বরং সিকিউরিটি সংস্থা থেকে ডেপুট করা যায়। সে অনুযায়ী যথাযথ বিধিবিধান প্রতিপালন করে ফিন্যান্স কমিটি এবং সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে ঢাকা রেস্ট হাউসের জন্য ছয়জন সিকিউরিটির সেবা হায়ার করা হয়েছে। উপাচার্য হিসেবে প্রায়শ আমাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, ধর্ম মন্ত্রণালয় (ইসলামী ফাউন্ডেশন), এইউবির সভা এবং গুচ্ছের সভাসমূহে যোগাযোগসহ প্রভৃতি কারণে ঢাকায় যেতে হয়। সে কারণে শিফট অনুযায়ী সিকিউরিটি সদস্য যারা রেস্ট হাউসে ডিউটি করে তাদের একজন রেস্ট হাউসে এবং একজনকে উপাচার্যের বাসায় ডিউটি বণ্টন করা হয়েছে মাত্র। উপাচার্যের বাসার জন্য কোনো সিকিউরিটি সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি। উপাচার্যের বাসার জন্য সিকিউরিটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এটাও একটি মিথ্যা প্রচারণা। প্রকৃতপক্ষে আমি জানি না উপাচার্য হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আর কী কী অভিযোগ রয়েছে? অভিযোগগুলো কীসের ভিত্তিতে করা হয়েছে? অভিযোগগুলো কারা করেছে তাও আমার জানা নেই। যা হোক, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রচার প্রপাগান্ডার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ইউজিসিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করিয়েছে। কমিটির সদস্যবৃন্দ আমাকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে লিখিত মতামত/বক্তব্য দিতে বলেছিলেন। আমি তাদের কাছে লিখিতভাবে (ডকুমেন্টসহ) আমার বক্তব্য প্রেরণ করেছি।
আশা করি পাঠকবৃন্দ বিষয়সমূহ অবহিত হয়ে একজন উপাচার্যকে কীভাবে কেবল রসালো, মিথ্যা, বানোয়াট এবং বস্তুনিষ্ঠহীন অভিযোগ তুলে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে-তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। উপাচার্য এবং ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলব, চেয়ারকে কলুষিত করিনি; আমি স্বার্থান্বেষী নষ্টভ্রষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করব না।
লেখক : উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Leave a Reply