January 26, 2025, 8:27 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বাংলাদেশের রাজনীতি-জেল-জুলুম-হুলিয়া-মুক্তি সংগ্রাম প্রভৃতির সাথে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি যে নামগুলো উচ্চারিত হতেই থাকবে যুগের পর যুগ তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সহধর্মিনী ; বঙ্গবন্ধুর সাথে বিয়ের পর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিটি সংগ্রামে তাঁর পাশে থেকে জুগিয়ে গিয়েছেন নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা এবং করে গেছেন সহযোগিতা। আজ ৮ অগাস্ট এই মহান নারীর ৯২তম জন্মবার্ষিকী।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গমাতার পিতা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক যশোরে কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্টে অডিটর পদে চাকরি করতেন। ৫ বছর বয়সী বড়মেয়ে জিন্নাতুন্নেছা এবং ২ বছর বয়সী ছোট মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা, ডাকনাম রেণুকে রেখে বাবা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং পরে মাতা হোসনে আরা বেগম পরপারে পাড়ি জমান। তখন এই দুই নাবালিকা অনাথ মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে বর্তায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা শেখ মো. আবুল কাসেমের ওপর। পিতৃমাতৃহারা হয়ে শিশু ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে খেলার সাথী হয়ে বড় হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে।
এরপর থেকে বঙ্গমাতাও যেন ধীরে ধীরে হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সহচর। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ১২ বছরই কাটাতে হয়েছে কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজের পরিবারের হাল ধরা, দলীয় নেতাকর্মীদের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কাজগুলো বঙ্গমাতা করে গিয়েছেন হাসিমুখেই। সুখে-দুঃখে বঙ্গবন্ধুর পাশে তিনি সবসময়ই ছিলেন; এর পাশাপাশি কিছু দারুণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি সুযোগ্য পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গমাতার অপর অনন্যসাধারণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। ইতিহাস বলছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যে বঙ্গমাতার সঠিক পরামর্শ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় তাঁর সহচররা ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বঙ্গমাতা এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে যা মন থেকে বলতে ইচ্ছে করে, যা বলা উচিত, তা-ই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। “এবারের সংগ্রাম—আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম—স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধীনতার ডাকে বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদের নাম নয়, শেখ মুজিবুর রহমান এক সাহসের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান এক আবেগের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান এক লড়াইয়ের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান এক জলন্ত প্রদীপের নাম, এই প্রদীপের শিখাকে সকল ঝড় ঝাঁপটায় যিনি আগলে রেখেছেন এবং বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে তাকে এগিয়ে দিয়েছেন তিনি হলেন জাতির পিতার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি আমাদের বঙ্গমাতা। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক নিঃস্বার্থ বন্ধু, যে বন্ধুটি সবসময় জাতির পিতাকে লড়াইয়ের জন্য সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সকল যুদ্ধে তিনি ছিলেন তার সহযোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন তার সহধর্মিণী জেলগেটে বসে তাকে তার জীবন কাহিনী লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য বই খাতা জেলগেটে জমা দিয়ে আসতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে তার আত্মজীবনী লেখার জন্য অনুরোধ করতেন।
বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে তার আইনজীবি নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া এমন খারাপ পরিস্থিতিতেও তিনি নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সময় তাকে বাইরের সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাড়িতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ যোগানো, দলের নেতাকর্মীদের রান্না করে খাওয়ানোসহ সকল কাজ বঙ্গমাতা পরম মমতার সাথে পালন করতেন। উল্লেখ্য যে মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ যোগাতে নিজের গহনা, ঘরের ফ্রিজ বিক্রয় করেছিলেন তিনি।
এইভাবে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছেন নতুন ইতিহাস রচনায়। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন এই মহীয়সী নারী। আমরা বাঙালিরা জাতি হিসেবে খুবই সৌভাগ্যবান যে আমরা জাতির পিতার পাশাপাশি একজন মাতাকেও পেয়েছি। বেগম ফজিলাতুন্নেছা শেখ মুজিবের যোগ্য সহধর্মিণী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন রতœগর্ভা মাতা। সকল ঝড় ঝাঁপটা, আন্দোলন সংগ্রামের মাঝেও তিনি সন্তানদেরকে সুশিক্ষা দিতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। তার প্রমাণ তাদের সকল সন্তানেরা, বিশেষত আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। এর থেকেই বোঝা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কতটা বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যার প্রভাব পড়েছে তার কন্যাদের উপর। তিনি একজন মহীয়সী নারী ছিলেন বলেই নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, পরিবারের স্বার্থের কথা না ভেবে এদেশের মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। নিজের সন্তানদের দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন। জাতির কল্যাণে, দেশের কল্যাণে সর্বোচ্চ সংগ্রাম করতে শিখিয়েছিলেন।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “তুমি আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।” বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা নৈতিক, মানবিক ও আদর্শিক শিক্ষায় ছিলেন স্থির এবং উজ্জ্বল।
১৯৭৫-এর সেই ভয়াল কালরাতে নির্মম, অপরিণামদর্শী ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তাঁর জীবনটাও নেয় কেড়ে। কিন্তু, সারাজীবন একজন যোগ্য সহচরের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তিনি যেন বাস্তবে প্রমাণ করে গিয়েছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অসাধারণ কবিতার মর্মবাণীকে—“কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী, / প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
Leave a Reply