December 14, 2024, 9:29 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
নানা কারনে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে খেজুরের গুড় খ্যাত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫ জেলায় কমছে খেজুরের গুড় উৎপাদন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে জেলাগুলোতে প্রতিবছরই কমছে খেজুরের গুড় উৎপাদন। জেলা গুলো হলো যশোর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও ঝিনাইদহ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় নানা সূত্র খেজুরের গুড় উৎপাদন কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারন চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গাছ কেটে ফেলা ও নতুন গাছ না লাগানো, শীতের ভেতর খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করার কষ্ট না করার প্রবণতা, দক্ষ গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া, গাছিদের পেশা বদল, খেজুর গাছের পরিবর্তে লাভজনক ফসল আবাদ, বাজারে কম দামে ভেজাল গুড়ের আধিক্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তারা খেজুরের রস সংগ্রহের আধুনিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষণায় জোর দেয়ার পাশাপাশি খেজুর গাছ রোপণের প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন।
পাঁচ বছর আগেও নড়াইল জেলায় বাণিজ্যিকভাবে এক হাজার টন খেজুর গুড় ও পাটালি উৎপাদন হলেও বর্তমানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। বর্তমানে এক কেজি খেজুর গুড় ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে পাঁচ বছর আগে নড়াইল জেলা থেকে প্রতি মৌসুমে অন্তত ৩০ কোটি টাকার খেজুর গুড় ও পাটালি বিক্রি হতো। এদিকে খেজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে পথে-প্রান্তরে, মাঠেঘাটে বেশি করে খেজুর গাছ রোপণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন গাছি, পরিবেশবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমীরা।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে এ জেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ ছিল। ওই বছর বাণিজ্যিকভাবে ৯১২ টন গুড় উৎপাদন হয়েছিল। বর্তমানে জেলায় কত হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ আছে তার কোনো হিসাব দিতে পারেনি কৃষি বিভাগ। এমনকি চলতি মৌসুমে গুড় ও পাটালি উৎপাদনেরও কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।
পৌর এলাকার দুর্গাপুর গ্রামের গাছি রেজাউল বলেন, তার বাবা সারাজীবন শীত মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করে সে রস দিয়ে গুড় ও পাটালি বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তিনি নিজেও বহু কষ্ট করে বাপের পেশাকে ২২ বছর যাবত আঁকড়ে ধরে আছেন। এ বছর তিনি ১৬০টি খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করছেন। প্রতিদিন তিনি এ কাজ করে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা রোজগার করেন। রেজাউল বলেন, একসময় তাদের গ্রামে চার-পাঁচজন গাছি ছিলেন। অন্য গাছিরা ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন। এলাকায় তিনি একাই এ পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।
লোহাগড়া উপজেলার আমাদা গ্রামের গাছি জামাল শেখ (৫৮) বলেন, একসময় তিনি প্রতি মৌসমে তিন-সাড়ে ৩০০ খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করতেন। এখন আর আগের মতো যেখানে-সেখানে খেজুর গাছ নেই। এ বছর ৬০টি খেজুর গাছ তুলেছেন (রস উপযোগী) তিনি। কয়েক সপ্তাহ হলো গাছে রস আসতে শুরু করেছে। আগে অনেক রস হতো সেই রস দিয়ে গুড় ও পাটালি বানিয়ে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করতেন তিনি। এখন গাছ কমে গেছে, তাই রসও কম হয়। গত তিন বছর যাবত গুড় বানানোর মতো এত বেশি রস হয় না।
মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকার গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় গ্রামাঞ্চলে অনেক খেজুর গাছ থাকলেও কালক্রমে সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন রকম চাহিদার প্রয়োজনে। জ্বালানি কাঠ ও কয়লার তুলনায় সস্তা হওয়ায় ইটভাটায় বিশেষ চাহিদা রয়েছে খেজুর গাছের। ইটভাটার চাহিদা মেটাতে মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অধিকাংশ খেজুর গাছই কাটা পড়েছে। এছাড়া খেজুর রস সংগ্রহ পেশার সঙ্গে জড়িতরা পেশা বদলে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ জানান, মাগুরায় এখনো ৫০ হাজারের অধিক খেজুর গাছ রয়েছে। গাছ বড় হওয়া ও গাছির অভাবে বেশির ভাগ গাছ থেকেই রস সংগ্রহ করা হচ্ছে না।
যশোরের গাছিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে কিছু অসাধু গাছি রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছেন। আর কৃষক বলছেন, এখন আর আগের মতো রস পাওয়া যায় না। গাছির অভাবে গাছও কাটা যাচ্ছে না। সে সঙ্গে শুরু হয়েছে গাছ থেকে রস চুরির হিড়িক।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার আট উপজেলায় মোট ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি গাছে রস হয়ে থাকে, যা থেকে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ লিটার রস পাওয়া যায়। আর গুড় তৈরি হয় ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ১৩ হাজার ১৭৩ কৃষক পরিবার সম্পৃক্ত।
এ ব্যাপারে যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, যশোরের উৎপাদিত খেজুরের গুড় এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। প্রতি মৌসুমে এখানকার মোট ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুর গাছ থেকে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু কিছু অসাধু চক্র গুড়ে চিনি মিশিয়ে এই গুড়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় উৎপাদিত উত্কৃষ্টমানের খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। শীতের চার মাস গাছিরা প্রতিদিন সকালে খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরি করেন। জেলার চারটি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ২ লাখ ১৩ হাজার ১৫০টি খেজুর গাছ থেকে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪৫০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
ঝিনাইদহের গাছিরা জানান, কনকনে শীত উপেক্ষা করে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনতে হয়। এরপর গৃহিণীরা অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে গুড় তৈরি করেন। ফলে বর্তমান সময়ে মানুষ আর গুড় তৈরির মতো কঠোর পরিশ্রম করতে চান না। ফলে দিনে দিনে গাছের সঙ্গে গাছিও কমে যাচ্ছে।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজগর আলী জানান, আগে অনেক কৃষক না বুঝে খেজুর গাছ ইটভাটায় বিক্রি করে দিতেন। আমরা এ গাছ সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি।
Leave a Reply