April 18, 2024, 2:19 pm

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন পোর্টাল

বিশেষ প্রদিবেদন/আজ কথা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের ১০৯তম মৃত্যু বার্ষিকী

ড. আমানুর আমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দ্য কুষ্টিয়া টাইমস/
আজ কথা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের ১০৯তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
মীর মশাররফ হোসেনের খ্যাতি রয়েছে উনবিংশের সব থেকে বড় মাপের মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে। বলা হয়ে থাকে তিনিই বাংলার মুসলিম সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করেছিলেন। দাবিটির যৌক্তিকতা উঠে আসে যখন দেখা যায় আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিষাদসিন্ধু ও জমিদার দর্পণের মতো সৃষ্টি রয়েছে তার ঝুলিতে এবং এ দিয়েই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের অগ্রদূত ও বাংলা গদ্যের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাঁকে গণ্য করা কেন হবে না এ ধরনের ভীতিকর প্রশ্নের অবসান ঘটে যাওয়া উচিত। তাঁর পূর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলমান সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। তিনিই ছিলেন অগ্রপথিক। তাঁর সাহিত্য কর্ম পরবর্তীকালে বহু মুসলিম সাহিত্যিককে সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত করে বিশেষ করে তাঁর বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা রীতি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভারে রয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ ও ধর্ম বিষয়ক পুস্তক, ও প্রবন্ধ রচনা প্রভৃতি ; ছিলেন সাংবাদিকতাতেও তিনি অত্যুজ্জল। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৭।
আজ ১৩ নভেম্বর মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৩তম জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করতেই এ লেখা।
১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নিকটবর্তী লাহিনী পাড়া গ্রামে মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম।
মীরের বংশ তালিকা পাওয়া যায় এভাবে সৈয়দ সা’দুল্লাহ, মীর উমর দরাজ, মীর ইব্রাহীম হোসেন, মীর মোয়াজ্জম হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন। তাঁর পিতা ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। বলা হয়েছে তাঁর পূর্ব পুরুষ সৈয়দ সা’দুল্লাহ বাগদাদ থেকে প্রথমে দিল্লীতে এসে মোগল সেনা বাহিনীতে চাকুরী গ্রহন করেন। পরে তিনি ফরিদপুর জেলার স্যাকরা গ্রামে আগমন করে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যার পাণি গ্রহন করে রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ঐ সময়ের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে গর্ভাবস্থায় নারীরা মাতা-পিতার বাড়ীতে চলে যায়। তার-ই ধারাবাহিকতায় মীর মোশাররফ হোসেন মাতৃগর্ভে থাকাবস’ায় তাঁর মাতা দৌলতন নেছাকে নিয়ে মীরের পিতা মোয়াজ্জেম হোসেন কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন মাইল পূর্ব গড়াই ব্রীজের নিকটস্থ লাহিনীপাড়া গ্রামে অর্থাৎ মীরের মাতামহের বাড়ী (নানা বাড়ী) চলে আসেন। মীর তার মাতাহের বাড়ীতেই জন্মগ্রহন করেন। মীরের মাতামহের মৃত্যুর পর পিতা মোয়াজ্জেম হোসেন কিছুদিন কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামেই বসবাস করেন।
মীরের পড়ালেখা আরম্ভ হয় গৃহেই। পরে ভর্তি হন গ্রামের জগমোহন নন্দীর পাঠশালায়। অল্প কিছুদিন কুমারখালী এম. এন. স্কুল ও কুষ্টিয়া হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৮৬০ সালে মীর মশাররফের মা দৌলতুন্নেসা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর মীর নিজ বাড়ী রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে ফিরে আসেন এবং পদমদী হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন।পরে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময় মীরের বয়স ছিল ১৩ বছর।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। একই উপজেলার ‘গ্রাম্য বার্তা’ সম্পাদক হরিণাথ মজুমদার ওরফে ‘কাঙাল হরিণাথ’ তার সাহিত্য গুরু ছিলেন। হরিনাথের পত্রিকাতেই তিনি লিখতেন। পরে ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।
অল্প বয়সেই তাঁর মধ্সাযে হিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। রতœাবতী ছিল তার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ । প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর। যখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর।
কর্মজীবনের দায় থেকে তিনি কিছুদিন ফরিদপুরের পদমদী নবাব এস্টেটে এবং কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। পরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার জমিদারী এস্টেটে ম্যানেজারিতেই কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। তাঁর বিষাদসিন্ধু গ্রন্থটি দেলদুয়ারে থাকার সময়ে লেখা।
ইতিহাস জানাচ্ছে জমিদারদের সঙ্গে বিবাদের কারণে ১৮৯২ সালে ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার লাহিনীপাড়ায় চলে আসেন। জমিদারি এস্টেটে কাজ করতে গিয়ে তিনি জমিদারদের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, সম্পত্তি লিপ্সা, ষড়যন্ত্র, হিংসা-বিদ্বেষ এবং নানা রকম অনাচার দেখেছিলেন। সে সবের বিবরণ আছে গাজী মিঞার বস্তানী ও ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ বই দুটিতে।
জমিদারি এস্টেটের কাজে মীর কলকাতায়ও ছিলেন ১৯০৩ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত।
মীর মশাররফ বাংলা কাব্য, প্রবন্ধ উপন্যাস রচনা করে উনবিংশে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের এক নব্য সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। ‘রতœাবতী’ থেকে ‘বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী’ প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে আরো মিশেল রচনা ছিল তাঁর এসবই সাহিত্য রস ও ভাবনা সৃষ্টিতে বিশেষ কৃতিত্ব রেখেছে। তাঁর গদ্যরীতি ছিল বিশুদ্ধ বাংলা। তিনি আরবী-ফারসী মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানী বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি ‘জমিদার দর্পন’ নাটক লিখে অন্যতম শ্রেষ্ট নাট্যকারের মর্যদা লাভ করেন। তাঁর বিষাদ সিন্ধু আজ অবধি প্রায় ১২০ বছর ধরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত আসন দখল করে আছে। ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলার মুসলমান সমাজে আজও শ্রদ্ধার সংগে পঠিত হয়। কারবালার করুণ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত এই উপন্যাসখানি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। মীর মশাররফ হোসেনের অপর গ্রন্থগুলি বাদ দিলেও মাত্র এই একখানি গ্রন্থ রচনার জন্য তাঁকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট লেখক আখ্যায়িত করা যায়।
মীর মশাররফ হোসেন প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিক’ (১৮৬৩) ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) পত্রিকায় টুকিটাকি সংবাদ প্ররণ করতেন। মশাররফ নানা বাড়ী লাহিনীপাড়া থেকে প্রথম স্ত্রীর নামে ‘আজিজন নেহার’ নামক একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮৭৪ সালে। সামান্য কয়েক মাস পর পত্রিকাখানি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৯০ সালে তিনি পুনরায় লাহিনীপাড়া থেকে ‘হিতকরী’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার কোথাও সম্পাদকের নাম ছিল না। ‘হিতকরীর’ কয়েকটি সংখ্যা টাঙ্গাইল থেকেও প্রকাশিত পয়েছিল। এ পত্রিকাখানির সহকারী সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত উকিল রাইচরণ দাস। মীর একটি (রবেনা সুদিন কুদিন কয়দিন গেলে) বাউল গান লিখে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের’ বাউল দলের সদস্য হন। ‘মশা বাউল’ ভণিতায় তিনি বেশকটি উতকৃষ্ট বাউল সংগীত রচনা করেছিলেন। সংগীত সম্বন্ধে মীরের বেশ ভাল জ্ঞান ছিল। তাঁর ‘সংগীত লহরীতে’ বিভিন্ন তালের অনেকগুলি উতকৃষ্ট সংগীত আছে।
মীর মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর প্রথম জীবনীকার ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় তাঁকে বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংগে তুলনা করেছেন।
মীর মশাররফ বেঁচে আছেন ও বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তির মাঝে। কোন কিংবদন্তি উপাধি না পেলেও কিংবদন্তি হয়েই সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন এই কথা সাহিত্যিক।

নিউজটি শেয়ার করুন..


Leave a Reply

Your email address will not be published.

পুরোনো খবর এখানে,তারিখ অনুযায়ী

MonTueWedThuFriSatSun
15161718192021
22232425262728
2930     
       
    123
       
   1234
26272829   
       
293031    
       
    123
25262728293031
       
  12345
27282930   
       
      1
9101112131415
3031     
    123
45678910
11121314151617
252627282930 
       
 123456
78910111213
28293031   
       
     12
3456789
24252627282930
31      
   1234
567891011
19202122232425
2627282930  
       
293031    
       
  12345
6789101112
       
  12345
2728     
       
      1
3031     
   1234
19202122232425
       
293031    
       
    123
45678910
       
  12345
27282930   
       
14151617181920
28      
       
       
       
    123
       
     12
31      
      1
2345678
16171819202122
23242526272829
3031     
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
242526272829 
       
© All rights reserved © 2021 dainikkushtia.net
Design & Developed BY Anamul Rasel