October 10, 2024, 1:31 am
জহির রায়হান সোহাগ, চুয়াডাঙ্গা/
চুয়াডাঙ্গা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। ছেলে বেলা থেকেই পাখিদের প্রতি যার রয়েছে অকৃত্রিম ভালবাসা। পুলিশে চাকুরির পরও পাখিদের সাথে অটুট রয়েছে তার বন্ধুত্ব। চুয়াডাঙ্গায় যোগদানের পর থেকে নিয়মিত পাখিদের খাবার খেতে দেন তিনি। প্রতিদিন ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা দেখা করতে আসে তার সাথে। দল বেঁধে আসে দিনের শুরুর আহারের আশায়। পাখিপ্রেমী মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের চারপাশে তখন পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ, আর কিচির মিচির ডাকে মুখরিত। চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বর ও রেলবাজারে নিত্যদিনের অতিথি পাখিদের আপ্যায়নে নিমগ্ন হন তিনি। ইতিমধ্যে পাখিদের বন্ধু হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন তিনি।
মূলত হোটেল-রেস্তোঁরার ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবার খেতো পাখিরা। করোনা মহামারীর সময়ে জেলায় লকডাউন শুরু হলে হোটেল রেস্তোঁরাসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এতে খাবারের কষ্ট হলে অনেকটা অনাহারে থাকতো পাখিরা। ঠিক তখন থেকেই দোকান থেকে খাবার কিনে পাখিদের খাওয়ান তিনি। তবে, এবার শীতে অতিথি পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান গড়তে গাছে গাছে নীড় বেঁধে দিচ্ছেন তিনি। জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। স্বামী বিবেকানন্দের এই বানীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাখিদের প্রতি আকৃষ্ট হন স্বপ্নবাজ ওই পুলিশ কর্মকর্তা। পাখিদের প্রতি তার ভালবাসার গল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গার গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে সারাদেশে। এখন পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে চুয়াডাঙ্গাবাসীর।
মাগুরা সদর উপজেলার চেঙ্গারডাঙ্গা গ্রামের প্রবিত বিশ্বাসের ছেলে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি মেজো। পুলিশের চাকুরিতে যোগদান করেন ৩ জুলাই ২০১১ সালে ঝিনাইদহে। সাতক্ষীরায় ট্রাফিকে বদলি হন ২০১৫ সালের প্রথম দিকে। পরে চুয়াডাঙ্গা ট্রাফিক পুলিশে বদলি হন ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ সালে। সেই থেকেই চুয়াডাঙ্গার পাখিরা তার বন্ধু হয়ে ওঠে। সকালে তাকে দেখলেই দল বেঁধে ছুটে আসে পাখিরা। করোনা মহামারীর প্রথম দিকে বন্ধ ছিল হোটেল রেস্তোঁরাগুলো। তখন থেকেই পাখিদের আহারের কথা ভেবে দোকান থেকে খাবার কেনেন তিনি। সকাল-দুপুর দু’বেলায় পাখিদের খেতে দেন চাল, শস্যদানা, চানাচুর। পাখির সাথে তার গভীর প্রেম দেখে রিতিমত অবাক হন পথচারীরা।
কথা হয় পাখিদের সাথে তার কর্মযজ্ঞ দেখতে আসা চুয়াডাঙ্গা শহরের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন, আব্দুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের সাথে। তারা জানান, পুলিশের সাথে পাখির বন্ধুত্ব এটা কল্পনা করাই যায় না। নিয়মিত পাখিদের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন তিনি। এসময় পাখিদের কিচির মিচির শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ। পাখির সাথে তার বন্ধুত্ব দেখে মন ভরে ওঠে সবার। পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের পাখির প্রতি নিখাঁদ ভালবাসা আমাদের পশু পাখিদের প্রতি মানবিক হতে শিক্ষা দেয়।
এই শীতের প্রথম থেকেই অতিথি পাখিদের অভয়াশ্রমের কথা চিন্তা করে গাছের ডালে ডালে বাঁধতে শুরু করেন পাখিদের নীড়। পাখিদের অভয়ারণ্য গড়তে নিজ উদ্যোগে চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রতিটি গাছের ডালে নীড় বেঁধে দিচ্ছেন তিনি। ‘পুলিশের বিচরণ যেখানে, পাখিদের অভয়ারণ্য সেখানে’ এই স্লোগানে পাখিদের বাসা গড়ার উদ্যোগ নেন পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস।
জেলার ৫টি থানা, একটি ফাঁড়ি ও ৩০টি ক্যাম্প ও ৩৯ টি স্থাপনায় পাখিদের অবাধ বিচরণে পাঁচ হাজার মাটির কলস ও বাঁশের তৈরি বাসা বেঁধে দেয়া হচ্ছে। যেখানে বাস করতে পারবে ২০-২৫ হাজার পাখি। পুলিশ লাইন, পুলিশ সুপারের বাস ভবন, পুলিশ পার্কসহ শহরের পাখিদের আনাগোনার স্থানে নিজ হাতে পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।
সার্জেন্ট মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস জানান, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। স্বামী বিবেকানন্দের এই বানীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাখিদের প্রতি স্নেহ জন্ম নেয় তার। মহামারী করোনার প্রথম দিকে মানুষ যখন গৃহবন্দী ছিলো তখন হোটেল ও রেস্তোঁরাগুলো বন্ধ থাকায় পাখিদের খাওয়ার কষ্ট হতো। তখন থেকেই দোকান থেকে খাবার কিনে দুই বেলায় পাখিদের খাবার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। পাখিদের খাবার খাইয়ে আত্মতৃপ্তি পান তিনি। তবে এবার পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান গড়তে নিজ উদ্যোগে ওই ধরণের কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন তিনি।
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস জানান,খুব ছোট থেকেই পশুপাখিদের প্রতি ভালবাসা রয়েছে তার।তখন থেকেই বাড়িতে পাখির ঘর তৈরি করে পাখি পোষা শুরু করেন তিনি। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় চাকুরি করা অবস্থায়ও বাড়িতেই পাখি পোষতেন। কিন্তু চুয়াডাঙ্গায় বদলি হয়ে আসার পর শহীদ হাসান চত্বরে পাখিদের মাঝে মধ্যে খাবার দিতেন তিনি। মূলত হোটেল-রেস্তোঁরার ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট খাবার খেতো পাখিরা। করোনা মহামারীর সময়ে জেলায় লকডাউন শুরু হলে হোটেল রেস্তোঁরাসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এতে খাবারের কষ্ট হলে অনেকটা অনাহারে থাকতো পাখিরা। ঠিক তখন থেকেই দোকান থেকে পাখিদের খাবার কিনে খাওয়ান তিনি। মাঝে মাঝে তার মহতি কাজের সারথি হয় একমাত্র মেয়ে শ্রেয়া বিশ্বাস।
ঝিনাইদহ প্রগতি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী শ্রেয়া বিশ্বাস জানান,বাবার সাথে পাখিদের খাবার দিতে এসে খুব আনন্দ পাই। তাদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। পাখিদের কিচির মিচির গান শুনতে অনেক ভাল লাগে। বড় হয়ে বাবার মতো আমিও পাখিদের নিয়মিত খেতে দেবো।
পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম জানান, পুলিশের কাজ শুধু মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই নয়, মানবিক কাজগুলোতেও অংশ নিচ্ছে পুলিশ। সেই কাজের অংশ হিসেবে পশু পাখিদের প্রতি ভালবাসার ওই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। পুলিশ এখন শুধু জনগণের নয়, প্রাণিদেরও। পাখিদের বন্ধু মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের মতো সকলকেই ওই ধরণের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের ওই ধরণের উদ্যোগ জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা শাখার সভাপতি পরিবেশবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একারণে পাখিরা মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস যুগপোযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
প্রতিদিন সকাল শেষে ব্যস্ত হতে শুরু করে লোকালয় জীবন। এই ব্যস্ততা শুরুর সাথে সাথে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের অতিথিরাও ডানা মেলে দেয় শূন্যে। দিনভর এসব পাখিরা প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করে। তবে সকালের খাবার খেতে ওরা ছুটে আসে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের কাছে।
Leave a Reply