October 9, 2024, 10:00 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া ডিজিটাল ডেস্ক/
দেশে এই মুহুর্তে ৬০ দশমিক ৩১ শতাংশ স্থানীয় পত্রিকা বন্ধ হয়ে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (বিআইজেএন)। শনিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করে সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী আমীর খসরু।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের ৩৪টি জেলার ৪৫৬টি স্থানীয় সংবাদপত্রের ওপর সম্প্রতি একটি জরিপ কাজ চালানো হয়। এতে দেখা যায় দেশের ৬০.৩১ শতাংশ অর্থাৎ ২৭৫টি স্থানীয় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। নিয়মিতভাবে চলছে ৩৫.৭৫ শতাংশ ও অনিয়মিতভাবে চলছে ৩.৯৫ শতাংশ পত্রিকা। তবে মার্চের শেষের দিকে করোনা শনাক্তের পর সব কাগজই কিছু দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
আমীর খসরু বলেন, সংবাদপত্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রধান কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট। একারণে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক তথ্য আর উঠে আসছে না। স্থানীয় অধিকাংশ সংবাদ জাতীয় পত্রিকার জায়গা পায় না। ফলে স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে এই তথ্য প্রবাহ সচল থাকে।
তিনি আরো বলেন, করোনাকালের আগের থেকে এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কমে গেছে, আবার স্থানীয় পত্রিকাগুলো বন্ধ হওয়ায় তথ্যপ্রবাহের একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এখানে বিআইজেএনের ব্ক্তব্য তুলে ধরা হলো/
করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের জীবন নানভাবে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে। করোনার ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক সঙ্কট মানুষকে এক নতুন হুমকি, অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। পরিবর্তিত এই নতুন এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ঝুঁকির সামনে পড়েছে। অস্তিত্বের লড়াইই এখন তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র তো অবশ্যই, রাজধানী ঢাকার বাইরের স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলোর সঙ্কট আরো তীব্রতর হয়েছে। এই কারনেই বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক বা বিআইজেএন গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে স্থানীয় সংবাদপত্রের বর্তমান পরিস্থিতি কি তা জানার চেষ্টা করেছে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক সংকট কতোটা ঝুঁকিতে ফেলেছে স্থানীয় সংবাদ পত্রগুলোকে – তা পর্যালোচনা করাই ছিল আমাদের এই প্রথম জরিপের উদ্দেশ্য ।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক বা বিআইজেএন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অবাধ অধিকার নিশ্চিতে পেশাদার, দলনিরপেক্ষ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকামী সাংবাদিকের একটি উদ্যোগমাত্র। এখানে বলে নেয়া প্রয়োজন যে, এই কার্যক্রমের সাথে ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পেশাদার সাংবাদিকগন জড়িত। এই সংগঠনের সাথে কোন এনজিও বা ব্যাক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত নয়। এটি পেশাদার ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের একটি নিজস্ব উদ্যোগমাত্র। আমরা দৃঢ়ভাবে চাই- সংবাদমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের যথাযথ স্বাধীনতা ও মুক্ত পরিবেশ। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, আমি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার সাথে বিআইজেএন-র কর্মকাণ্ডের সামান্যতম সম্পর্ক বা সংশ্লেষ নেই। একই সাথে বিভিন্ন স্থান থেকে যারা এই সংগঠনের সাথে জড়িত তারা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে নয়- একজন পেশাগত সাংবাদিক হিসেবেই এই উদ্যোগের সাথে জড়িত।
জরিপ :/
করোনাকালের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যেও বিভিন্ন স্থানের সাংবাদিকরা এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন। এই জরিপের জন্য আমরা রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের ৩৪টি জেলার ৪৫৬টি স্থানীয় দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার উপরে তথ্য সংগ্রহ করি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। মিডিয়াভুক্ত সংবাদপত্রগুলোর তালিকার ভিত্তিতে নয়, স্থানীয়ভাবে যেসব সংবাদপত্র করোনাকালের আগে প্রকাশিত হতো- তাই এই জরিপের আওতায় আনা হয়। আবার স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ার কারণে সম্ভাব্য কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে- ওই বিষয়ে মতামত জানতে আমরা আলাদাভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানের ২৮৭ জন সাধারণ মানুষসহ বিশিষ্টজনের টেলিফোন সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। জরিপের তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ছিল ২৩ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত। প্রাথমিকভাবে “উদ্দেশ্যভিত্তিক দৈবচয়ন নমুনায়ন” পদ্ধতিতে জেলাসমূহ নির্বাচন করা হয়। এখানে মূল নির্ণায়ক ছিল ঢাকা শহরের বাইরের স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে গবেষণার আওতায় নিয়ে আসা। এর পরে দৈনিক এবং সাপ্তাহিক সংবাদপত্রগুলো নির্বাচিত হয়েছিল তাদের প্রচার, পাঠকের কাছে পৌঁছানো এবং নিয়মিত প্রকাশের ধরণের ভিত্তিতে। এর লক্ষ্য ছিল স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো সম্পর্কে ধারণা নেয়া। ভবিষ্যতে আরো বড় ধরণের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হলে দেশের সকল জেলা নিয়ে ব্যপকভিত্তিক কাজ করা হবে।
প্রতিটি পরিবর্তনশীল উপাত্তের জন্য ক্রমিক তথ্য তালিকা (ডাটা শীট) তৈরি করা হয়েছিল- যা কোড অনুসারে সংকলন করা হয়। সংখ্যাত্মক মূল্যায়নের উপাত্তগুলো লিপিবদ্ধ করার সময় শুদ্ধতা যাচাই (ক্রসচেক) এর জন্য বেশকিছু ব্যবস্থাগ্রহন করা হয়েছিল। এছাড়া গুণগত তথ্যের সাথে ধারাবাহিকতার বিষয়টিও যাচাই করা হয়েছে। তথ্যের অসম্পূর্ণতা এবং লিপিবদ্ধ করার ত্রু টিগুলি তথ্য বিশ্লেষণের আগে পরীক্ষা করে সংশোধন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে একই বিষয়ে আরো গবেষণার জন্য তথ্যগুলো নিয়ে একটি ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে এবং এসপিএসএস পিসি সংস্করণ ১৩.০ পরিসংখ্যান সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
জরিপের ফলাফল
আমাদের জরিপে যে ফলাফল তাতে দেখা গেছে , ৪৫৬টি সংবাদপত্রের মধ্যে ২৭৫টি (৬০.৩১%) করেনোকালে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অনিয়মিত অর্থাৎ বিজ্ঞাপন পেলে অথবা অর্থ জোগাড় করতে পারলে ১৮টি (৩.৯৫%) সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়। আর ওই সময়কালে নিয়মিত প্রকাশের চেষ্টা করা হয় ১৬৩ টি (৩৫.৭৫%) পত্রিকা। তবে প্রায় সব কাগজই মার্চের করোনা সংক্রমণ সনাক্ত হওয়ার পরে পুরোপুরি কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে এসব কাগজের মধ্য থেকে উল্লিখিত সংখ্যক সংবাদপত্র নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এই জরিপ কাজে দেখা গেছে, কমপক্ষে ছয়টি জেলায় সংবাদপত্রগুলো আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে আমাদের জরিপে আর্থিক সঙ্কটকই প্রধানতম কারণ বলে তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সংবাদপত্র বন্ধের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া/
স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ২৮৭ ব্যক্তির সাথে স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিষয়ে ফোনালাপ করা হয়েছে। এখানে কয়েকধরণের মতামত পাওয়া গেছে। মতামতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিবেচনায় নিচে তা উপস্থাপন করা হলো
১। ৮৬.৪১ শতাংশ জবাবদানকারী জানিয়েছেন যে স্থানীয় পর্যায়ের কাগজগুলো ঐ স্থানের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে থেকে এবং কখনো কখনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীপর্যায়ের দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিব্যবহার এবং নানাবিধ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আইন বহির্ভূত ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন ভঙ্গের খবর প্রচারের এক-একটি মাধ্যম ছিল। যদিও এতে ব্যাপক মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে নানাবিধ বাঁধা বিঘ্ন সৃষ্টির চেষ্টাও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারপরও ঐসব খবরগুলো কোনো না কোনোভাবে এবং এক বা একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকাগুলো খোলা থাকলে করোনাকালে নানা খবরাখবর ও তথ্য প্রকাশ হতে পারত।
১.১। প্রথমোক্তদের সাথে সুর মিলিয়ে আরেকটি মতামত পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে আমরা (স্থানীয়ব্যক্তি) সহজে এই সমস্ত পত্রিকা এবং সাংবাদিকদের কাছে যেতে পারতাম এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খবর কোন না কোন স্থানীয় কাগজে ছাপা হতো।
১.২। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে যে সমস্ত খবরাখবর আমরা পেতাম সেসব খবরের অধিকাংশই জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে স্থান পায় না। কিছু জাতীয় পত্রিকায় এই ধরনের খবরগুলো সামান্য ছাপা হলেও বিস্তারিত পাওয়া যায় না।
১.৩। আমরা (স্থানীয়) ব্যক্তি মনে করতাম, স্থানীয় প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং তার সাথে “সাঙ্গপাঙ্গরা” স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের কারণে কিছুটা হলেও চাপের মধ্যে থাকত।
২। সাক্ষাৎকারে ৮.৭২ শতাংশ জবাবদানকারী কিছুটা ভিন্ন মতামত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে নানা ধরণের সাংবাদিকতা-বহির্ভূত অপকর্ম করা হতো এবং সাংবাদিক নাম ভাঙ্গিয়ে তারা নানা ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক পক্ষের সাথে অবৈধভাবে যুক্ত ছিল।
৩। এর বাইরে ৪.৮ শতাংশ জবাবদানকারী পত্রিকার বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরণের মতামত পোষণ করেননি।
বিআইজেএন-এর পর্যবেক্ষণ
১। স্থানীয় পর্যায়ে বিশাল সংখ্যক সংবাদপত্র বন্ধ ও অনিয়মিত হওয়ার ফলে জনগণের সংবাদপ্রাপ্তির বিষয়টি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।
২। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে নানা মাত্রিক কর্তৃত্বপরায়ণতা বেড়ে যাবার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।
৩। প্রশাসনের ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্তরকেন্দ্রিক খবরপ্রাপ্তির দূরত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের সাথে খবরপ্রাপ্তিতে এককেন্দ্রিকতার সৃষ্টি হতে পারে।
৪। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ও সামগ্রিকভাবে গনতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে সংবাদপত্র বন্ধের কারণে একটি বড় মাত্রার দুর্বলতা দেখা দেবে ।
৫। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের যে ক্রমাগত দুর্বলতার অবস্থাটি ছিল তা আরও সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়বে- যা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর জন্য একটি বড় ধরণের ক্ষতি।
৬. স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমে পেশাদার সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংখ্যা কমে যাবে।
Leave a Reply